স্মার্ট হোম: প্রযুক্তির বিস্ময়কর অবদান
আমরা মানুষেরা পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে স্মার্ট জীব। অন্যান্য প্রাণীদের মতো আমরা হামাগুড়ি দিয়ে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, দৌড়াদৌড়ি করে সারা পৃথিবী চলি না। আমাদের কোন সমস্যা হলে আমরা একে অপরের সাথে কথা বলি, কোন বিষয় নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হয় এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিন বদলের সাথে আমরা নিজেদেরও বদলিয়ে নিয়েছি প্রয়োজন অনুসারে; আমাদের চারপাশে সর্বদা সাহায্য করার জন্য রয়েছে নানান প্রকারের গ্যাজেট আর ইলেকট্রিক/ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি। এখন এটা কেমন হয়, যদি প্রত্যেকটি গ্যাজেট ঠিক আমাদের মতো নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে আরম্ভ করে, আপনি বাড়িতে না থাকলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়ির সব দরজা জানলা লক হয়ে যাবে। বাড়ি থেকে বেড় হয়ে এসে সর্বদায় মনে পরে, “লাইট বন্ধ করেছি তো?” “টিভি, মিউজিক প্লেয়ার বেজেই চলছে না তো?” “চুলায় আগুন ধরেই নেই তো?” — কেমন হয় যদি প্রত্যেকটি ডিভাইজকে রিমোট ভাবে অ্যাক্সেস করা যায় ? এই আর্টিকেলে এমন এক বাড়ির সম্পর্কে জানবো যেটা টেকের ছোঁয়ায়, আপনার জীবনকে আরো সহজ করে দেবে। অথবা বলতে পারেন, এক ভবিষ্যৎ বাড়ি, যেটা নিজের খেয়াল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেই রাখতে পারে। — তো চলুন, বিস্তারিত সবকিছু জেনে নেওয়া যাক---
স্মার্ট হোম এমন কিছু ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলো একটি সেন্ট্রাল কম্পিউটার কন্ট্রোল সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রত্যেকটি সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য থাকবে বিভিন্ন সেন্সর, যেমন হিট সেন্সর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘরের তাপমাত্রা চেক করবে এবং সে অনুসারে এসি নিয়ন্ত্রন করবে। আবার ফটোইলেকট্রিক সেন্সর অন্ধকার মেপে ঘরের বাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু করে দেবে। এভাবে প্রত্যেকটি যন্ত্রপাতি এই সেন্ট্রাল সিস্টেমটির সাথে সংযুক্ত থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করবে
স্মার্টহোম এর ধারণা মোটেই নতুন কিছু নয়, ১৯৮০ সালের দিকে আমেরিকায় এটি পরিচিতি লাভ করে ইন্টেলিজেন্ট বিল্ডিং নামে ৷ খুব সহজভাবে বলতে গেলে, স্মার্ট হোম এমন একটি প্রোগ্রাম উপযোগী হোম অটোমেশন সিস্টেম, যা একটি বাড়ির তিনটি মূল অংশ- হিটিং সিস্টেম, লাইটিং সিস্টেম এবং সিকিউরিটি কন্ট্রোল সিস্টেম সংশ্লিষ্ট ডিভাইসগুলোকে স্মার্ট উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করবে ৷ সেই সাথে পুরো হোম অটোমেশন সিস্টেমটি হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ৷ হোম অটোমেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে হোম নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে একটি বাড়ির নিরাপত্তা, বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা, হোম এন্টারটেইনমেন্ট ইত্যাদি প্রতিটি সিস্টেম আলাদা আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং একই সাথে এগুলোর সমন্বয় সাধন করাই স্মার্ট হোমের লক্ষ্য
একটি স্মার্ট হোমে ঠিক কী কী ডিভাইস থাকা দরকার, তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট মানদ নেই ৷ তবে কমপক্ষে অবশ্যই হিটিং সিস্টেম, লাইটিং এবং সিকিউরিটি কন্ট্রোল সিস্টেম থাকতে হবে ৷ আর তাহলেই একে স্মার্ট হোম বলা যাবে ৷ এছাড়া অতিরিক্ত কোনো ডিভাইস যুক্ত করা না করার বিষয়টি ব্যবহারকারীর ওপর নির্ভর করে ৷ স্মার্ট হোমের অনেক বৈশিষ্ট্য চলতি সময়ের সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোতে চোখে পড়ে, একটি আধুনিক বাড়ির সাথে স্মার্ট হোমের পার্থক্য হলো, এখানে বিভিন্ন সিস্টেম ও ডিভাইসের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ করার একটি পথ তৈরি করে দেয়া থাকে ৷ একটি আধুনিক বাড়িতে নানারকম সিস্টেম থাকে ৷ যেমন- ফায়ার সিস্টেম, সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম, সিকিউরিটি সিস্টেম ইত্যাদি ৷ এছাড়া থাকে বিভিন্ন ডিভাইস : টেলিভিশন, মিউজিক সিস্টেম, লাইট, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ সরঞ্জাম ইত্যাদি ৷ কিন্তু এসব সিস্টেম ও ডিভাইসগুলো একটি অপরটি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ৷ স্মার্ট হোমে এসব ডিভাইস এবং সিস্টেম একে অপরের সাথে তথ্য দেয়া-নেয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করার জন্য সিগন্যাল পাঠাতে পারে, যাকে কমান্ড বলা হয়ে থাকে ৷ বিগত দশকে বাইরের দেশগুলোতে একটি বাড়ির বিভিন্ন ডিভাইস নিয়ন্ত্রণের জন্য কম্পিউটারের ব্যবহার ক্রমাগতই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ৷ ওয়াশিং মেশিন, হিটিং সিস্টেম, মাইক্রোওয়েভ সরঞ্জাম ইত্যাদি যখন পিসির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটি বাড়ি কন্ট্রোল করার এবং এর নিরাপত্তা রক্ষার নতুন ও কার্যকর উপায় মানুষ খুঁজে পেয়েছে ৷ স্মার্ট হোম তৈরি করতে গিয়ে আসলে কয়েকটি কম্পিউটারের ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ৷ এরপর তাদের মাঝে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করার মাধ্যমে এক জায়গা থেকে তাদেরকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে ৷ আর এরই ফলে ম্যানুয়ালি একটি সুইচ অন করা বা কোনো নব ঘুরিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা কমে এসেছে ৷ ঘরের বিভিন্ন উপাদান দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ অথবা এগুলো দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে
এই কম্পিউটারগুলো নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং ক্যাবল দিয়ে যুক্ত থাকে বা একে অপরের সাথে ডাটা আদান-প্রদানের জন্য ওয়্যারলেস সিগন্যাল ব্যবহার করে থাকে ৷ কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হবার ফলে স্মার্ট হোমের বিভিন্ন ধরনের অপারেশন খুব সহজ হয়ে পড়েছে ৷ যেমন- স্মার্ট হোম সিকিউরিটি অ্যালার্ম প্যানেল নামে মাইক্রোপ্রসেসর যুক্ত ডিভাইস রয়েছে ৷ একে টেলিফোনের মাধ্যমে বাইরে থেকে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য কমান্ড দেয়া যায় এবং একই সাথে একে আনসারিং মেশিন হিসেবে ব্যবহার করা যায় ৷ তবে এতে যোগাযোগ করে কমান্ড দেবার জন্য নির্দিষ্ট একটি পিন নম্বর দিতে হয়, যা সিকিউরিটি নম্বর নামে পরিচিত ৷ এতে স্মার্ট হোমের ব্যবহারকারী ছাড়া আর কেউ কমান্ড দিতে পারে না
সমন্বিত নিরাপত্তা
সিকিউরিটি অ্যালার্ম প্যানেলের মাধ্যমে স্মার্ট হোমের ভেতরের ডিভাইসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে বাসার ভেতরে প্রতিটি রুমের নিরাপত্তা আলাদা আলাদাভাবে মনিটর করার সুযোগ রয়েছে ৷ বাসা ছেড়ে বের হবার সময় মাত্র একটি সুইচ চেপেই সিকিউরিটি অ্যালার্ম, গাড়ির অ্যালার্ম অন করা যাবে ৷ বাসার সব লাইট অফ এবং ঘরের খোলা দরজা-জানালা বন্ধ করা যাবে ৷ বাড়ি ফিরে আসার সময়ও এই একটি সিগন্যালই সবকিছুকে আগের অবস্থাতে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট ৷ কয়েকদিনের জন্য আপনি যদি বাড়ির বাইরে থাকেন, তবে ইন্টিগ্রেটেড সিকিউরিটি সিস্টেম বা সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজে থেকেই দিনের বেলায় প্রতিটি ঘরের লাইট বন্ধ রাখবে ৷ রাতে তা অন করে দেবে৷ পর্দা টেনে দেবে, যাতে বাড়িটি জনমানবশূন্য মনে না হয়
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
যদি ঘরে কোথাও গ্যাস লিক হয়, তবে ডিটেক্টর তা জেনে মেইন সোর্স থেকে গ্যাসের প্রবাহ বন্ধ করে দেবে এবং অ্যালার্ম বাজাবে ৷ একই সাথে ঘরের লাইটগুলো বন্ধ করে দেবে, যাতে স্পার্ক তৈরি হবার কোনো সুযোগ সৃষ্টি না হয় ৷ ঘরে আগুন লেগে গেলে স্মোক এবং হিট ডিটেক্টর তা জেনে নিয়ে কয়েকটি কাজ একসাথে করতে পারে ৷ যেমন- ঘরের সবগুলো লাইট ফ্ল্যাশ করার সাথে সাথে তীক্ষ্ণ সাইরেন বাজাতে পারে ৷ যদি ঘরে কেউ থাকে, তবে সবগুলো দরজা খুলে দিয়ে তাকে দ্রুত বের হতে সহায়তা করতে পারে
ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
স্মার্ট হোমের রয়েছে ঘরের তাপমাত্রা নিজের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা ৷ বাইরের বিরূপ আবহাওয়াকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে প্রতিটি রুমের তাপমাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন করা যায় ৷ যেমন- রাতের বেলা থেকে ভোর পর্যন্ত ঘুমানোর সময় তাপমাত্রার যে প্রাকৃতিক পরিবর্তনটুকু হয়ে থাকে, সেই একই পরিবর্তন কৃত্রিমভাবে ঘরের ভেতর নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে দিনের যেকোনো সময়ে ৷ শুধু আপনাকে উল্লেখ করে দিতে হবে আপনি কখন ঘুমাতে ও কখন ঘুম থেকে উঠতে চাইছেন এবং কি হারে তাপমাত্রার পরিবর্তন আপনার পছন্দ ৷ এই হিসেবগুলো নিখুঁত হলে দিন-রাতের পার্থক্যের সীমাবদ্ধতা স্মার্ট হোমের মাধ্যমে অনেকটাই ঘোচানো যায়
জীবনযাত্রাকে সহজ করে
স্মার্ট হোম মানুষের জীবনযাত্রাকে একেবারে সহজ এবং ঝামেলাহীন করে তুলবে ৷ এছাড়া কারো যদি রাতে জেগে ওঠার অভ্যাস থাকে, তবে সে জেগে ওঠার সাথে সাথেই মোশন ডিটেক্টর দিয়ে তা ডিটেক্ট করে স্মার্ট হোম নিজে থেকেই ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেবে, যাতে অন্ধকারে হোঁচট না খেতে হয় ৷ টেলিভিশন দেখার সময় রিমোট কন্ট্রোলের একটি সুইচ চেপেই ঘরের পর্দা টেনে দিয়ে এবং ঘরের লাইটের উজ্জ্বলতা কমিয়ে দিয়ে টিভি দেখার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা যায় ৷
Really amazing home!
উত্তরমুছুন